Tuesday 30 April 2013

পুণ্যভূমি মক্কা : মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদক: মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
Makka-02
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী মুসলিম মাত্রেই মক্কা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। মক্কা শব্দটি উচ্চারিত হতেই তিনি হৃদয়ে এক গভীর ভালোবাসা অনুভব করেন। তার অন্তরে এ নগরীকে দুচোখ জুড়ে দেখার এবং এখানে অবস্থিত আল্লাহর মহাপবিত্র ঘর কা‘বা যিয়ারতের একান্ত আকাঙ্ক্ষা লালন করেন। আর যারা হজ বা উমরা করতে চান, তাদেরকে অবশ্যই এ পবিত্র ভূমিতে গমন করতে হয়। তাই এ সম্মানিত শহর সম্পর্কে জানা প্রতিটি মুসলিমের একান্ত কর্তব্য। নিম্নে তাই পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এ মহান নগরীর কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হল :
ক. কুরআন কারীমে পবিত্র মক্কা নগরীর কয়েকটি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ১- মক্কা {আল-ফাতহ : ২৪}; ২- বাক্কা {সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬}; ৩- উম্মুল কুরা (প্রধান শহর) {সূরা আশ-শূরা, আয়াত : ৭}; ৪- আল-বালাদুল আমীন (নিরাপদ শহর) {সূরা আত-তীন, আয়াত : ৩}। বস্তুত কোনো কিছুর নাম বেশি হওয়া তার মর্যাদা ও মাহাত্ম্যেরই পরিচায়ক।
খ. আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে হারাম শরীফের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে। জিবরীল আলাইহিস সালাম কা‘বা ঘরের নির্মাতা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে হারামের সীমানা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর দেখানো মতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তা নির্ধারণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে হারামের সীমানা সংস্কার করা হয়। [আল-ইসাবা : ১/১৮৩]
ইমাম নববী রহ. বলেন, হারামের সীমানা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এর সঙ্গে অনেক বিধি-বিধানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। [তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত : ৩/৮২]
গ. মক্কা নগরীতে আল্লাহ তা‘আলার অনেক নিদর্শন রয়েছে : যেমন, আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে এ মর্মে বলেন,

﴿ فِيهِ ءَايَٰتُۢ بَيِّنَٰتٞ مَّقَامُ إِبۡرَٰهِيمَۖ ﴾ [ال عمران: ٩٧]

‘তাতে (মক্কা নগরীতে) রয়েছে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন যেমন মাকামে ইবরাহীম।’ [সূরা আলে-ইমরান, আয়াত : ৯৭]
কাতাদা ও মুজাহিদ রহ. বলেন, ‘প্রকাশ্য নিদর্শনগুলোর একটি হলো মাকামে ইবরাহীম।’ [তাফসীরে তাবারী : ৪/৮]
মূলত মক্কা নগরীর একাধিক নাম, এর সীমারেখা সুনির্ধারিত থাকা, এর প্রাথমিক পর্যায় ও নির্মাণের সূচনা এবং একে হারাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ নগরীর সম্মান ও উঁচু মর্যাদার কথা ফুটে ওঠে। তাই দেখা যায় ইতিহাসের পরম্পরায় সবসময়ই পৃথিবীর বুকে মানুষ পবিত্র মক্কার আলাদা মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য মেনে নিয়ে এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে।
মক্কার অতুলনীয় মর্যাদা :
১. আল্লাহ তা‘আলা মক্কা নগরীকে হারাম (সম্মানিত) ঘোষণা করেছেন :
আল্লাহ তা‘আলা যে দিন যমীন ও আসমান সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মক্কা ভূমিকে সম্মানিত করেছেন। পবিত্র কুরআনে  ইরশাদ হয়েছে,

﴿ إِنَّمَآ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ رَبَّ هَٰذِهِ ٱلۡبَلۡدَةِ ٱلَّذِي حَرَّمَهَا ﴾ [النمل: ٩١]

‘আমিতো আদিষ্ট হয়েছি এ নগরীর মালিকের ইবাদাত করতে যিনি একে সম্মানিত করেছেন।’ [সূরা আন-নামল, আয়াত : ৯১]
একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় আল্লাহর প্রিয় রাসূলের মুখেও। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ هَذَا الْبَلَدَ حَرَّمَهُ اللهُ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ فَهُوَ حَرَامٌ بِحُرْمَةِ اللهِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ. »

‘এ শহরটিকে আল্লাহ যমীন ও আসমান সৃষ্টির দিন থেকেই হারাম অর্থাৎ সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ কর্তৃক সম্মানিত এ শহরটি কিয়ামত পর্যন্ত সম্মানিত থাকবে। [মুসলিম : ১৩৫৩]
আল্লাহর খলীল ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম মক্কাকে হারাম হওয়ার ঘোষণা দেন। আল্লাহর নির্দেশে তিনি আল্লাহর ঘর কা‘বা নির্মাণ করেন এবং একে পবিত্র ঘোষণা করেন। অতপর মানুষের উদ্দেশে তিনি হজের ঘোষণা দেন এবং মক্কা নগরীর জন্য দু‘আ করেন। আবদুল্লাহ ইবন যায়েদ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ إِبْرَاهِيمَ حَرَّمَ مَكَّةَ وَدَعَا لَهَا. »

‘নিশ্চয় ইবরাহীম মক্কাকে হারাম ঘোষণা করেন এবং শহরটির জন্য দু‘আ করেন।’ [বুখারী : ১৮৮৩; মুসলিম : ১৩৮৩]
২. আল্লাহ মক্কা নগরীর কসম খেয়ে তাকে সম্মানিত করেছেন :
আল্লাহ কর্তৃক কোনো কিছুর কসম খাওয়া তার সম্মানের প্রমাণ বহন করে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ এই মক্কার কসম খেয়েছেন। মক্কা নগরীর কসম খেয়ে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿ وَٱلتِّينِ وَٱلزَّيۡتُونِ ١ وَطُورِ سِينِينَ ٢ وَهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ٱلۡأَمِينِ ٣ ﴾ [التين: ١،  ٣]

‘কসম তীন ও যাইতূনের। কসম সিনাই পর্বতের। এবং কসম এ নিরাপদ শহরের।’ [সূরা আত-তীন, আয়াত : ১-৩]
আয়াতে ‘এই নিরাপদ শহর’ বলে মক্কা নগরী বুঝানো হয়েছে। আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ لَآ أُقۡسِمُ بِهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ١ وَأَنتَ حِلُّۢ بِهَٰذَا ٱلۡبَلَدِ ٢ ﴾ [البلد: ١،  ٢]

‘আমি কসম করছি এ শহরের। আর আপনি এ শহরের অধিবাসী।’ [সূরা আল-বালাদ, আয়াত : ১-২]
৩. মক্কা ও এর অধিবাসীর জন্য ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দু‘আ করেছেন :
মক্কা নগরী শুধু মর্যাদাবান তাই নয়, এর নগরীতে যারা বাস করবেন তাদের জন্য আল্লাহর নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বহু আগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দু‘আও করেছেন। যার ফলে মক্কা হলো বিশ্বের সবচে নিরাপদ ও শান্তির স্থান। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿ وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِيمُ رَبِّ ٱجۡعَلۡ هَٰذَا ٱلۡبَلَدَ ءَامِنٗا وَٱجۡنُبۡنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعۡبُدَ ٱلۡأَصۡنَامَ ٣٥ ﴾ [ابراهيم: ٣٥]

‘আর (স্মরণ করুন) যখন ইবরাহীম বলেছিলেন, হে আমার রব, এ শহরকে নিরাপদ করুন এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে মূর্তি পূজা হতে দূরে রাখুন।’ [সূরা ইবরাহীম, আয়াত : ৩৫]
৪. মক্কা রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তম শহর :
মক্কা ছিল আমাদের প্রিয় নবীর প্রিয় শহর। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা শরীফের উদ্দেশে বলেন,

« مَا أَطْيَبَكِ مِنْ بَلَدٍ وَمَا أَحَبَّكِ إِلَيَّ وَلَوْلاَ أَنَّ قَوْمَك أَخْرَجُونِي مِنْكِ مَا سَكَنْتُ غَيْرَكِ. »

‘কতই না পবিত্র শহর তুমি, আমার কাছে কতই না প্রিয় তুমি! যদি তোমার কওম আমাকে তোমার থেকে বের করে না দিত, তাহলে তুমি ছাড়া অন্য কোনো শহরে আমি বসবাস করতাম না।’ [আল-মু‘জামুল কাবীর : ১০৪৭৭]
৫. দাজ্জাল এ নগরীতে প্রবেশ করতে পারবে না :
কিয়ামতের পূর্বলগ্নে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে দাজ্জাল সদম্ভ বিচরণ করবে। কেবল মক্কা ও মদীনায় সে প্রবেশ করতে পারবে না। আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَيْسَ مِنْ بَلَدٍ إِلَّا سَيَطَؤُهُ الدَّجَّالُ، إِلَّا مَكَّةَ، وَالمَدِينَةَ، لَيْسَ لَهُ مِنْ نِقَابِهَا نَقْبٌ، إِلَّا عَلَيْهِ المَلاَئِكَةُ صَافِّينَ يَحْرُسُونَهَا، ثُمَّ تَرْجُفُ المَدِينَةُ بِأَهْلِهَا ثَلاَثَ رَجَفَاتٍ، فَيُخْرِجُ اللَّهُ كُلَّ كَافِرٍ وَمُنَافِقٍ. »
‘এমন কোনো ভূখণ্ড নেই যা দাজ্জালের পদভারে মথিত হবে না। তবে মক্কা ও মদীনায় সে প্রবেশ করতে পারবে না। সেখানকার প্রতিটি গলিতে ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে পাহারায় নিয়োজিত থাকবে। এরপর মদীনা তার অধিবাসীসহ তিনটি ঝাঁকুনি দেবে। যার ফলে আল্লাহ (মদীনা থেকে) সকল কাফির ও মুনাফিককে বের করে দেবেন।’ [বুখারী : ১৮৮১; মুসলিম : ২৯৪৩]
৬. ঈমানের প্রত্যাবর্তন :
কিয়ামতের আগে মানুষের ঈমানের জগতে চরম বিপর্যয় ঘটবে। মানুষ ঈমান থেকে যোজন দূরে চলে যাবে। দুনিয়া থেকে ঈমান ও ঈমানদার উধাও হয়ে যাবে। তখন ঈমান আর ঈমানদারদের পাওয়া যাবে মক্কা ও মদীনায় তথা মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে। আবদুল্লাহ ইব্ন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ الإِسْلاَمَ بَدَأَ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ غَرِيبًا كَمَا بَدَأَ وَهُوَ يَأْرِزُ بَيْنَ الْمَسْجِدَيْنِ كَمَا تَأْرِزُ الْحَيَّةُ فِى جُحْرِهَا. »
‘ইসলামের সূচনা হয়েছিল অপরিচিত হিসেবে এবং সূচনা কালের মতই আবার তা অপরিচিত অবস্থার দিকে ফিরে যাবে। আর তা পুনরায় দু’টি মসজিদে ফিরে আসবে, যেমন সাপ নিজ গর্তে ফিরে আসে।’ [মুসলিম : ১৪৩; সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ১১৭৩]
ইমাম নববী রহ. বলেন, ‘দু’টি মসজিদ দ্বারা মক্কা ও মদীনার মসজিদকে বুঝানো হয়েছে।’ [মুসলিম : ৩৯০]
৭. মসজিদুল হারামে সালাত আদায়ের ছাওয়াব :  
মক্কায় অবস্থিত মসজিদে হারামে সালাত আদায়ের মাধ্যমে অকল্পনীয় নেকী লাভ করা যায়, যা অন্য কোথায় হাসিল করা যায় না। জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«صَلاَةٌ فِى مَسْجِدِى هَذَا أَفْضَلُ مِنْ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ إِلاَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ وَصَلاَةٌ فِى الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَفْضَلُ مِنْ مِائَةِ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ. »

‘আমার মসজিদে একবার সালাত আদায় মসজিদে হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদে হাজারবার সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি উত্তম। তবে মসজিদুল হারামে একবার সালাত আদায় অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এক লক্ষ গুণ বেশি।’ [মুসনাদে আহমাদ : ১৫২৭২; ইব্ন মাজা : ১৪০৬; সহীহ ইব্ন খুযাইমা : ১১৫৫]
মসজিদে হারাম বলতে কেউ কেউ শুধু কা‘বার চতুষ্পার্শ্বস্থ সালাত আদায় করার স্থান বা মসজিদকে বুঝেছেন; কিন্তু অধিকাংশ শরীয়তবিদের মতে, হারামের সীমারেখাভুক্ত পূর্ণ এলাকা মসজিদে হারামের আওতাভুক্ত। প্রসিদ্ধ তাবেঈ ‘আতা ইব্ন আবী রাবাহ আল-মক্কী রহ. যিনি মসজিদে হারামের ইমাম ছিলেন। তাঁকে একবার রাবী‘ ইব্ন সুবাইহ রহ. প্রশ্ন করলেন, ‘হে আবূ মুহাম্মাদ! মসজিদে হারাম সম্পর্কে যে ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এটা কি কেবল মসজিদের জন্য না সম্পূর্ণ হারাম এলাকার জন্য?’ জবাবে আতা‘ রহ. বললেন, এর দ্বারা সম্পূর্ণ হারাম এলাকাই বুঝানো হয়েছে। কারণ, হারাম এলাকার সবটাই মসজিদ বলে গণ্য করা হয়।’ [মুসনাদুত তায়ালিসী : ১৪৬৪]
অধিকাংশ আলেম এ মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। [আল-ইখতিয়ারাতুল ফিকহিয়্যা লিল- ইমাম ইব্ন তাইমিয়া : পৃ. ১১৩; ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মা‘আদ : ৩/৩০৩-৩০৪; মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইব্ন বায : ৪/১৪০]
সুতরাং পবিত্র মক্কা নগরীর হারাম এলাকার যেখানেই সালাত আদায় করা হবে, সেখানেই এক সালাতে এক লক্ষ সালাতের ছাওয়াব পাওয়া যাবে।
৮. মসজিদে হারামের উদ্দেশে সফর করার গুরুত্ব :
আল্লাহর যমীনে ইবাদাতের উদ্দেশে কোনো জায়গা সফরের অনুমতি নেই কেবল তিনটি জায়গা ছাড়া। হ্যাঁ, সফর যে কোনো জায়গায়ই করা যেতে পারে, কিন্তু তা হবে ইবাদাত জ্ঞানে নয়; তাঁর সৃষ্টিদর্শন ও পরিচয় বা সৃষ্টিকুশলতা অবলোকনের অভিপ্রায়ে। সেই তিনটি জায়গার একটি হলো এই মক্কার মসজিদ তথা মসজিদে হারাম। আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

«لَا تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ مَسْجِدِي هَذَا وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَالْمَسْجِدِ الْأَقْصَى»

‘(ইবাদাত মনে করে) কোথায় সফর করা যাবে কেবল তিনটি মসজিদ ছাড়া। আমার এই (মদীনার) মসজিদ, মসজিদে হারাম এবং মসজিদে আকসা (ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাসের মসজিদ)।’ [বুখারী : ১১৮৯; মুসলিম : ১৩৯৭]
অতএব আমাদের কর্তব্য হবে একজন মুসলিম হিসেবে হৃদয়ে মক্কার প্রতি গভীর ভালোবাসা লালন করা এবং যথাসাধ্য মক্কা ও মদীনার মসজিদে সালাত আদায় করে ছাওয়াব হাসিলে সচেষ্ট হওয়া। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর হাবীবের এ প্রিয় শহর এবং তাঁর সম্মানিত ঘর দর্শন ও যিয়ারতের তাওফীক দান করুন। আমীন।

জেদ্দায় অবস্থিত কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয় ২ বছর মেয়াদী আরবী স্কলারশিপ প্রোগ্রাম

●|● ২ বছর মেয়াদী আরবী স্কলারশিপ প্রোগ্রাম। শুধুমাত্র ১৭-২৫ বছর বয়সী ছেলেদের জন্য ●|●
আলহামদুলিল্লাহ্‌, জেদ্দায় অবস্থিত কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয় ২ বছর মেদায়ী আরবী স্কলারশিপ প্রোগ্রামের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ করছে।
প্রোগ্রামটি শুরু হবে এই বছরের (২০১৩) সেপ্টেম্বর মাসে, ইনশাআল্লাহ্‌।
প্রোগ্রামটি সম্পূর্ণ ফ্রী! সাথে রয়েছে থাকা এবং তিনবেলা খাবারের সুব্যবস্থা। আরও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মাসিক ভাতা!
আবেদন করার জন্য আপানকে যা করতে হবে :
১. প্রথমেই আপনাকে অনলাইন আবেদন ফর্ম পূরণ করতে হবে। এজন্য এই লিঙ্কে যায় : http://ali.kau.edu.sa/Pages-text12.aspx
২. এরপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের পিডিএফ (PDF) ই-মেইল করতে হবে এই ঠিকানায় : ali@kau.edu.sa
প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা পেতে এই লিঙ্কে যান : http://ali.kau.edu.sa/Pages-text10.aspx । পেইজের নীচের অংশে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা দেওয়া আছে।
আবেদন ফর্ম পূরণের শেষ তারিখ : বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০১৩।
(প্রোগ্রামটি শুধুমাত্র ১৭-২৫ বছর বয়সী পুরুষদের জন্য। আপনার বয়সসীমা ১৭-২৫ বছরের মধ্যে না হলে, আপনার আবেদনপত্র গ্রহণযোগ্য হবে না।)
আপনি বিবাহিত হলেও আবেদন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে নিজেকেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জেদ্দায় পৌঁছে স্ত্রীর জন্য ভিসা আবেদন করতে পারবেন।

মানব ও সমাজসেবায় ইসলামের প্রেরণা

সংকলন: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদক: মো: আব্দুল কাদের
Islam_is_Peace_by_MeAli_ADK
‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও
তার মত সুখ কোথাও কি আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’
অন্যের ব্যথায় সমব্যথী হওয়া এবং পরের বিপদে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা একটি মহৎ গুণ। এক ধরনের নেকীর কাজ। হিতৈষী মনোভাব ও সহমর্মিতার গুণ ছাড়া মানবিকতা ও মহানুভবতার বিকাশ পূর্ণতা পায় না।
আমি তিনবেলা পেট পুরে খেতে পারি। একাধিক পদের তরকারি ছাড়া আমার খাবার রোচে না। বিচিত্র স্বাদ আস্বাদন ছাড়া আমার রসনা তৃপ্ত হয় না। বাসার নৈশ প্রহরী কুকুরকে নিত্য টাটকা গোশত খাওয়াই। দুই বেলা শাহী খাবার খেতে দেই। শ্যাম্পু ছাড়া ওর গোসল হয় না। অথচ পাশের বস্তিতে খাবার না পেয়ে অবোধ শিশুরা চিৎকার করে কাঁদে। জঠরজ্বালা সইতে না পেরে কত বনী আদম পথের ধারে উপুড় হয়ে কাতরায়। ফল-ফ্রুটস খেতে খেতে আমার আদরের দুলালের অরুচি ধরে যায়। অথচ বাড়ির বুয়ার অভুক্ত সন্তানদের মুখে মৌসুমী ফলটি পর্যন্ত ওঠে না। ক্ষুদে মাছির লঘু পদভার পড়ামাত্র সুডৌল আপেল, রসে টইটুম্বর আঙ্গুর ও টসটসে কমলা ওরা প্রায়শই নিক্ষেপ করে ডাস্টবিনে। অথচ এরা পঁচা ও উচ্ছিষ্ট ফল খাওয়ার জন্য ইতর প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধ করে ডাস্টবিনে। ফ্যাশন বদলের সঙ্গে সঙ্গেই আমার মেয়ের শীতবস্ত্র আর গ্রীষ্মের পোশাক বদল হয়। অথচ অদূরের গাঁয়েই কি-না শীতবস্ত্রের অভাবে গরীবের প্রাণ যায়।
এসব তো বিবেক বা মানবতার পরিচায়ক নয়। অমানবের চেয়ে মানব শ্রেষ্ঠ কেন? প্রাণের কারণে? কেবল বুদ্ধির কারণে? মোটেও না। প্রাণের বৈশিষ্ট্যে মানুষ ও জীব-জন্তু প্রায় অভিন্ন। মানুষ বুদ্ধিমান জীব বলে অন্য সব জীবজন্তু একেবারে বুদ্ধিহীন নয়। বরং বুদ্ধির সঙ্গে বিবেক এবং আপন চাহিদার সঙ্গে মানবিকতার সংশ্লেষই অন্য সব জীব-জন্তুর ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছে। ইসলাম এ কারণে মানব সমাজে এমন বৈষম্য ও প্রভেদের কোনো সুযোগ রাখে নি। ইসলাম মানুষকে সর্বোচ্চ মানবিকতা, পরহিতৈষণা, সহমর্মিতা ও মহানুভবতার শিক্ষা দিয়েছে। এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাঁর নবীকে প্রেরণ দয়া ও সহমর্মিতার প্রতীক হিসেবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧﴾ [الأنبياء: ١٠٧]

‘আর আমি আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ [ সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭]
অনাহারীর কষ্টের ভাগিদার হতে এবং জনমদুখী বান্দার দুঃখে সমব্যথী হতে আল্লাহ তা‘আলা রমযানের সিয়াম ফরয করেছেন। দুঃখীর অভাব মোচনে যাকাত ফরয ও সাদাকুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। একই উদ্দেশে সালাত, সিয়াম ইত্যাদির ফিদইয়া ও লে‘আনের বিধান এবং কসম ইত্যাদির কাফফার বিধান প্রবর্তন করেছেন। দান-সদকা ও অন্যের জন্য খরচে উদ্বুদ্ধ করে অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমন :
ক. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَّن ذَا ٱلَّذِي يُقۡرِضُ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗا فَيُضَٰعِفَهُۥ لَهُۥ وَلَهُۥٓ أَجۡرٞ كَرِيمٞ ١١﴾ [الحديد: ١١]

‘এমন কে আছে যে, আল্লাহকে উত্তম করয দেবে? তাহলে তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।’ [ সূরা আল-হাদীদ, আয়াত : ১১]
খ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَّن ذَا ٱلَّذِي يُقۡرِضُ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗا فَيُضَٰعِفَهُۥ لَهُۥٓ أَضۡعَافٗا كَثِيرَةٗۚ وَٱللَّهُ يَقۡبِضُ وَيَبۡصُۜطُ وَإِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٢٤٥﴾ [البقرة: ٢٤٥]

‘কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে, ফলে তিনি তার জন্য বহু গুণে বাড়িয়ে দেবেন? আর আল্লাহ সংকীর্ণ করেন ও প্রসারিত করেন এবং তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরানো হবে।’ [ সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৬১]

গ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَّثَلُ ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمۡوَٰلَهُمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنۢبَتَتۡ سَبۡعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنۢبُلَةٖ مِّاْئَةُ حَبَّةٖۗ وَٱللَّهُ يُضَٰعِفُ لِمَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٌ ٢٦١﴾ [البقرة: ٢٦١]   

‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ’ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ [সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৬১]

ঘ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ ٱلۡمُصَّدِّقِينَ وَٱلۡمُصَّدِّقَٰتِ وَأَقۡرَضُواْ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗا يُضَٰعَفُ لَهُمۡ وَلَهُمۡ أَجۡرٞ كَرِيمٞ ١٨﴾ [الحديد: ١٨]

‘নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী এবং যারা আল্লাহকে উত্তম করয দেয়, তাদের জন্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়া হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।’ [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত : ১৮]
ঙ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ وَٱسۡمَعُواْ وَأَطِيعُواْ وَأَنفِقُواْ خَيۡرٗا لِّأَنفُسِكُمۡۗ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفۡسِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٦ إِن تُقۡرِضُواْ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗا يُضَٰعِفۡهُ لَكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۚ وَٱللَّهُ شَكُورٌ حَلِيمٌ ١٧﴾ [التغابن: ١٦،  ١٧]

‘অতএব তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর, শ্রবণ কর, আনুগত্য কর এবং তোমাদের নিজদের কল্যাণে ব্যয় কর, আর যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়, তারাই মূলত সফলকাম। যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তিনি তা তোমাদের জন্য দ্বিগুন করে দিবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, পরম ধৈর্যশীল।’   [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত : ১৬-১৭]
চ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَقۡرِضُواْ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗاۚ وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِ هُوَ خَيۡرٗا وَأَعۡظَمَ أَجۡرٗاۚ وَٱسۡتَغۡفِرُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمُۢ ٢٠﴾ [المزمل: ٢٠]

‘আর সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। আর তোমরা নিজদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু অগ্রে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তর রূপে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ [ সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত : ২০]
ছ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَفِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ ١٩ ﴾ [الذاريات: ١٩] 

‘আর তাদের ধনসম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক।’ {সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত : ১৯}
জ. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَٱلَّذِينَ فِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ مَّعۡلُومٞ ٢٤ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ ٢٥ ﴾ [المعارج: ٢٤،  ٢٥] 

‘আর যাদের ধন-সম্পদে রয়েছে নির্ধারিত হক, যাচ্ঞাকারী ও বঞ্চিতের’। {সূরা আল-মা‘আরিজ, আয়াত : ২৪-২৫}
এ ধরনের আরো অসংখ্য আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মানবের সেবা ও সমাজের কল্যাণের নির্দেশ ও উৎসাহ দিয়েছেন। তেমনি মানবমুক্তি ও সমাজকল্যাণের মহান প্রতিভূ মুহাম্মদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনভর এ শিক্ষা প্রচার করেছেন। মানবসেবা ও সমাজকল্যাণের চর্চা করেছেন আপন কর্মে যেমন, তেমনি নানা উপলক্ষ্যে নানাভাবে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন আপন বাণী বা উক্তিসমগ্রে। কিয়ামত অবধি আগত মানবতার শান্তি ও কল্যাণে তিনি অনাগত সকল ঈমানদারের সামনে এ আদর্শ রেখে গেছেন।
নবুওয়ত লাভের প্রাক্কালে হিলফুল ফুযূল নামক সংস্থা গড়েছিলেন। সেখানে কিছু যুবককে নিয়ে তিনি এ মর্মে অঙ্গিকারাবদ্ধ হন, ‘আমরা নিঃস্ব ও অসহায় দুর্গতদের সেবা করব। অত্যাচারী প্রাণপণে বাধা দেব, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করব এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনে সচেষ্ট হব।’ [বিশ্বনবী পৃ. : ৫৭]
সেকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আর্তমানব সেবার অনন্য উপমা খুঁজে পাওয়া যায় মা খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহার প্রজ্ঞাপূর্ণ উক্তিতে। প্রথম ওহী দর্শনে ভীত-সন্ত্রস্ত স্বামীকে অভয় দিতে গিয়ে যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন। যেমনটি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিআল্লাহু আনহা সূত্রে ইমাম বুখারীর সহীহ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আস্বস্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন,

« كَلَّا وَاللَّهِ مَا يُخْزِيكَ اللَّهُ أَبَدًا، إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ ، وَتَحْمِلُ الكَلَّ، وَتَكْسِبُ المَعْدُومَ، وَتَقْرِي الضَّيْفَ، وَتُعِينُ عَلَى نَوَائِبِ الحَقِّ».

(ভার্বার্থ) ‘কখনো নয়, আল্লাহর শপথ, আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। কারণ, আপনি আত্মীয়দের প্রতি দয়াশীল, পীড়িত মা ও আতুরদের ব্যয়ভার বহন করেন, নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করেন, আপনি অতিথিপরায়ন এবং সত্যিকার বিপদাপদে সদা সাহায্যকারী।’ [বুখারী : ০৩; মুসলিম : ৪২২]
৬ষ্ঠ হিজরীর শেষের দিকে খায়বার বিজিত হয়। ৯ম হিজরীতে যখন আরব উপদ্বীপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুগত হয়,   তখন তিনি বিশাল রাজ্যের অধিপতি। চারদিক থেকে মদীনায় যত ধন-দৌলত প্রেরিত হয় সবই তিনি অকাতরে বিলিয়ে দেন অনাথ ও দুস্থদের মাঝে। নিজে কিছুই ভোগ করেন না তিনি। মা আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার ভাষ্য মতে, তিনি এমনভাবে ইহলোক ত্যাগ করেছেন যে তাঁর পরিবার লাগাতার দু’দিন পেট পুরে যবের রুটি খেতে পারে নি।
প্রখ্যাত সাহাবী জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে কখনো কোনো প্রার্থীকে ‘না’ বলেন নি। তাঁর বদান্যতা, পরোপকার, মানবসেবা ও সমাজকল্যাণে অবদানের অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাস ও হাদীস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ হয়েছে। মানব সেবায় গুরুত্বারোপ এবং এতে উদ্বুদ্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসংখ্য বাণী উচ্চারণ করেছেন, স্বল্প পরিসরে যা উল্লেখ সম্ভব নয়। সেদিকে না দিয়ে সংক্ষেপে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক।
আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

«مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَاللَّهُ فِى عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِى عَوْنِ أَخِيهِ».

‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে কিয়ামতের কষ্টসমূহ থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সাহায্যে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়।’ [মুসলিম : ৭০২৮; আবূ দাঊদ : ৪৯৪৮; তিরমিযী : ১৪২৫]
অপর হাদীসে রয়েছে, প্রখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لاَ وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ ، لاَ وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ ، لاَ وَاللَّهِ لاَ يُؤْمِنُ قَالُوا : وَمَنْ ذَاكَ يَا رَسُولَ اللهِ ؟ قَالَ : جَارٌ لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ ، قِيلَ : وَمَا بَوَائِقُهُ ؟ قَالَ : شَرُّهُ.

‘না, আল্লাহর কসম সে ঈমান আনে নি’; ‘না, আল্লাহর কসম সে ঈমান আনে নি’; ‘না, আল্লাহর কসম সে ঈমান আনে নি’। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, ‘সেই ব্যক্তি  যার হঠকারিতা থেকে প্রতিবেশি নিরাপদ নয়।’ জিজ্ঞেস করা হলো, হঠকারিতা কী? তিনি বললেন, ‘তার অনিষ্ট বা জুলুম’। [মুসনাদ আহমদ : ৮৪১৩; মুসনাদ বাযযার : ২০২৬]
বলাবাহুল্য আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের অপচয় করা অথচ নিকটস্থ অসহায়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করাও এক ধরনের জুলুম।
একে অপরকে সাহায্য করা, একে অন্যকে যৎসামান্য হলেও কিছু দেয়াও তাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

«يَا نِسَاءَ الْمُسْلِمَاتِ لاَ تَحْقِرَنَّ جَارَةٌ لِجَارَتِهَا وَلَوْ فِرْسِنَ شَاةٍ».

‘হে মুসলিম নারীগণ, এক প্রতিবেশি যেন তার অপর প্রতিবেশির পাঠানো দানকে তুচ্ছজ্ঞান না করে, যদিও তা ছাগলের পায়ের একটি ক্ষুর হয়।’ [বুখারী : ২৫৬৬; মুসলিম : ২২৬]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দারিদ্রক্লিষ্ট বনী আদম এবং অসহায় নারীদের সাহায্যে উদ্বুদ্ধ করেছেন ব্যাপকভাবে। আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

« السَّاعِى عَلَى الأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ كَالْمُجَاهِدِ فِى سَبِيلِ اللَّهِ - وَأَحْسِبُهُ قَالَ - وَكَالْقَائِمِ لاَ يَفْتُرُ وَكَالصَّائِمِ لاَ يُفْطِرُ ».

‘বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।’ (বর্ণনাকারী বলেন,) আমার ধারণা তিনি আরও বলেন, ‘এবং সে ওই সালাত আদায়কারীর ন্যায় যার ক্লান্তি নেই এবং ওই সিয়াম পালনকারীর ন্যায় যার সিয়ামে বিরাম নেই।’ [বুখারী : ৬০০৭; মুসলিম : ৭৬৫৯]
তিনি স্ত্রীদের প্রতি সবিশেষভাবে সহমর্মিতা ও দয়ার্দ্র আচরণের উপদেশ দিয়েছেন। আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

« اسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ ، فَإِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ ، وَإِنَّ أَعْوَجَ شَىْءٍ فِى الضِّلَعِ أَعْلاَهُ ، فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ ، وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ ، فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ »

‘তোমরা (সদুপদেশ ও সদাচারের মাধ্যমে) নারীদের কল্যাণ কামনা করো, কেননা নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের হাড় থেকে। আর পাঁজরের হাড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাঁকা হাড় হলো ওপরেরটি। তুমি যদি সেটি সোজা করতে যাও তাহলে তা ভেঙ্গে ফেলবে। আর নিজ অবস্থায় যদি ছেড়ে দাও তবে তা বাঁকা হতেই থাকবে। সুতরাং সদুপদেশ ও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে নারীর কল্যাণ কামনা করো।’ [বুখারী : ৩৩৩১; মুসলিম : ২৬৭১]
স্ত্রীর প্রতি সদাচারে তাগিদ দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন বাণীও উচ্চারণ করেছেন যা নিয়ে আমাদের মা-বোনেরা সত্যিই গর্ব করতে পারেন। যা লজ্জা দিতে পারে তথাকথিত নারী স্বাধীনতার ধ্বজাধারীদের। মা আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

« خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِى ».

‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম যে স্ত্রীর কাছে তোমাদের মধ্যে উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীর কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম।’ [তিরমিযী : ৩৮৯৫]
অন্য ভাইয়ের প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়া, অন্যের আহ্বানে সাড়া দেয়াকে তিনি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এটাকে তিনি ঐচ্ছিক হিসেবে নয়; একেবারে দায়িত্বের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। যেমন : আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

« حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ سِتٌّ ». قِيلَ مَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ « إِذَا لَقِيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ وَإِذَا دَعَاكَ فَأَجِبْهُ وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ وَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللَّهَ فَسَمِّتْهُ وَإِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ وَإِذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ ».

‘এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। বলা হলো সেগুলো কী হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, (১) তুমি যখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তাকে সালাম দেবে। (২) সে যখন তোমাকে নিমন্ত্রণ করবে তা গ্রহণ করবে। (৩) সে যখন তোমার মঙ্গল কামনা করবে, তুমিও তার মঙ্গল কামনা করবে। (৪) যখন সে হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলবে, তখন তুমি ইয়ারহামুকাল্লাহ (আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত করুন) বলবে। (৫) যখন সে অসুস্থ হবে তাকে, দেখতে যাবে। (৬) এবং যখন সে মারা যাবে, তখন তার জানাযায় অংশগ্রহণ করবে।’ [মুসলিম : ৫৭৭৮; মুসনাদ আহমাদ : ৮৮৩২]
আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ মূসা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

« عُودُوا الْمَرِيضَ، وَأَطْعِمُوا الْجَائِعَ، وَفُكُّوا الْعَانِيَ ».

‘অসুস্থ লোকের সেবা করো, ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করো।’ [বুখারী : ৫৬৪৯; মুসনাদ আবী ই‘আলা : ৭৩২৫]
মানবসেবা ও সমাজকল্যাণে ইসলামের অতি আগ্রহ এবং অনন্ত প্রেরণার স্বাক্ষর হিসেবে আর কিছু নয় কেবল নিম্নোক্ত হাদীসে কুদসীই যথেষ্ট হতে পারে। আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

« إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِى. قَالَ يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُودُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ. قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِى فُلاَنًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِى عِنْدَهُ يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمْنِى. قَالَ يَا رَبِّ وَكَيْفَ أُطْعِمُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ. قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهُ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِى فُلاَنٌ فَلَمْ تُطْعِمْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِى يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تَسْقِنِى. قَالَ يَا رَبِّ كَيْفَ أَسْقِيكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ قَالَ اسْتَسْقَاكَ عَبْدِى فُلاَنٌ فَلَمْ تَسْقِهِ أَمَا إِنَّكَ لَوْ سَقَيْتَهُ وَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِى ».

‘কেয়ামত দিবসে নিশ্চয় আল্লাহ তাআ’লা বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার শুশ্রূষা করো নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক। আপনিতো বিশ্বপালনকর্তা কিভাবে আমি আপনার শুশ্রূষা করব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তাকে তুমি দেখতে যাও নি। তুমি কি জান না, যদি তুমি তার শুশ্রূষা করতে তবে তুমি তার কাছেই আমাকে পেতে।?’ ‘হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে আহার করাও নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব, তুমি হলে বিশ্ব পালনকর্তা, তোমাকে আমি কীভাবে আহার করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জান না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি খাদ্য দাও নি। তুমি কি জান না যে, তুমি যদি তাকে আহার করাতে বে আজ তা প্রাপ্ত হতে।?’ ‘হে আদম সন্তান, তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম, অথচ তুমি আমাকে পানীয় দাও নি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রভু, তুমি তো রাব্বুল আলামীন তোমাকে আমি কীভাবে পান করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল কিন্তু তাকে তুমি পান করাও নি। তাকে যদি পান করাতে তবে নিশ্চয় আজ তা প্রাপ্ত হতে।’ [মুসলিম : ৬৭২১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৭৩৬]
এত সব আয়াত ও হাদীসকে সামনে রাখলে কোনো মুসলিমের পক্ষেই সমাজসেবা বিমুখ হওয়া সম্ভব নয়। কুরআন-সুন্নাহর ধারক-বাহক উলামায়ে কিরাম তাই এ ব্যাপারে সবসময় সচেতন ছিলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যায় আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ বিদায়ের পর থেকে দুইশ বছরের গোলামীর ক্ষতি পুষিয়ে এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জিত হয় নি। জাগতিক লাভের উদ্দেশে কিংবা আত্মপ্রচারমুখী সংস্থা, দল বা ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে যেমন সন্তোষজনক জনসেবা জাতি নিকট অতীতে পায় নি; তেমনি উলামায়ে কিরামকেও এ অঙ্গনে পর্যাপ্ত সংখ্যায় সম্পৃক্ত হতে দেখা যায় নি। আশার কথা হলো বর্তমান আলেম সমাজ ও ইসলামী আদর্শের লোকেরা জনসেবামূলক বিভিন্ন সংস্থা তথা ইসলামভিত্তিক এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর্ত মানবতার সেবায় তারাও ব্যাপকভাবে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম, আল-মুনাতাদা আল-আসলামী, আল-মারকাযুল ইসলামী, আন-নাদিল ইমদাদী আল-ইসলামীসহ খ্যাত-অখ্যাত অনেক ইসলামী সাহায্য সংস্থা মানবসেবায় এগিয়ে এসেছে এবং উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
অতি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, বাংলাদেশে বর্তমানে কর্মরত প্রায় ১৬ হাজার এনজিওর মধ্যে অধিকাংশের ব্যাপারে খ্রিস্টধর্ম প্রচার, ধর্মান্তর প্রচেষ্টা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনভিপ্রেত নাক গলানো এবং সেবার নামে আসা কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অসংখ্য নজির ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমগুলো যথেষ্ট সমালোচনা মুখর নয়। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে সরকারও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হচ্ছে না। তাদের সম্পর্কে দেশে নাশকতা ও দুষ্কৃতিমূলক কাজে সহায়তা করার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় না। পক্ষান্তরে নিষ্ঠা ও সততার সাথে কর্মরত মুসলিম এনজিওগুলোকে জঙ্গিদের মদদদানের অজুহাতে অনেক ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণ ছাড়াই হয়রানির শিকার হতে হয়। শুধু বাংলাদেশে নয়; অনেক মুসলিমপ্রধান দেশেই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা বিরাজ করছে।
পরিশেষে ইসলামী এনজিওগুলোর উদ্দেশে বলতে চাই আপনারা নিজেদের কর্মকাণ্ড শুধু মসজিদ-মাদরাসা স্থাপন, কুরআন শিক্ষা ইত্যাদির মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে এতিমদের পুনর্বাসন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বিধবাদের সহায়তা প্রদান, যৌতুক প্রতিরোধ, মাদকদ্রব্য নির্মূল, বৃক্ষরোপন, স্যানিটেশন প্রকল্প, ইসলামভিত্তিক ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প, বেকারদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সেবাকর্মের মাধ্যমে মানুষের আরও কাছে ঘেঁষতে চেষ্টা করুন। আর্ত-মানবতার সেবায় ইসলামের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরুন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই পার্থিব লালসা ও ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসের রোগ থেকে নিজেদের দূরে থাকতে হবে। জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে ব্যাপক সেবাকর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিন ইসলাম শুধু মুসলমানের জন্যই আসে নি বরং পৃথিবীর সব মানুষের জন্যই এসেছে। এছাড়াও ভুল বোঝাবুঝি ও অপপ্রচার রোধে নিজেদের সেবার ক্ষেত্র, আয়ের উৎস ইত্যাদির বিবরণ সম্বলিত তথ্য সরকার ও জনসমক্ষে তুলে ধরে আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়টিও নিশ্চিত করুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
keeping ties
আত্মীয়তা-সম্পর্ক ও এর মাহাত্ম্য
এটি এমন এক বিষয় যার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা মানুষের রিজিক বাড়িয়ে দেন, হায়াত দীর্ঘ করেন, এবং মানুষের ধন-সম্পদে বরকত দেন। এটি হলো আত্মীয়তা-সম্পর্ক। আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলতে বুঝানো হয়, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এবং এসবের উর্ধ্বতন ও নিম্নতন আত্মীয়।
আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা যে জরুরী, আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্ন করা যে হারাম আর আত্মীয়দের ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর রাখা, বিপদাপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সার্বিক কল্যাণ কামনা করার ফযীলত সম্পর্কে কুরআনে কারিমে এবং হাদীসে অনেক বাণী উল্লিখিত হয়েছে। আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে তাদের প্রশংসায় তিনি ইরশাদ করেন,

﴿وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ (21) ﴾

‘আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করে, আর মন্দ হিসাবের আশঙ্কা করে।’[সূরা আর-রা‘দ : ২১]
পক্ষান্তরে যারা এ সম্পর্ক অটুট রাখে না তীব্র ভাষায় তাদের ভৎর্সনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ (25) ﴾

‘আর যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই লা‘নত আর তাদের জন্যই রয়েছ আখিরাতের মন্দ আবাস।’[সূরা আর-রা‘দ : ২৫]
যারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে না তাদের ধমক দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ (22) أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ (23) ﴾

‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই যাদেরকে আল্লাহ লানত করেন, তাদেরকে বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন।’[সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩]
রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচারের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا﴾

‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক।’[সূরা আন-নিসা : ০১]
এসব আয়াত থেকে আমরা সুস্পষ্ট বুঝতে পারি আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আত্মীয়তা-সম্পর্ক অক্ষুণ্ন  রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এ সম্পর্ক ক্ষুণ্ন করতে নিষেধ করেছেন।
প্রিয় পাঠক, আমরা কি আল্লাহর বাণীর মর্ম অনুধাবন করেছি? আমরা কি রাব্বুল আলামিনের ডাকেন সাড়া দেব না? নাকি এরপরও আমরা আত্মীয়-পরিজনদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবো? নিজেদের গোমরাহিতে ডুবে থাকবো? আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতার পুনরাবৃত্তি করতে থাকবো? আর রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালনে উদাসীন থাকবো?
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللهَ خَلَقَ الْخَلْقَ حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ خَلْقِهِ قَالَتِ الرَّحِمُ هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيعَةِ قَالَ نَعَمْ أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ قَالَ فَهُوَ لَكِ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ ﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾

আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি জীবের সৃজন কাজ শুরু করেন। যখন তিনি এ কাজ সমাপ্ত করেন, আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলে উঠল, ‘এটি আপনার কাছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্নকারীর আশ্রয়স্থান’। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, ‘হ্যা, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে তোমাকে জুড়ে রাখবে আমিও তার সঙ্গে জুড়ে থাকবো আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমিও তাকে ছিন্ন করবো?’ আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলল, ‘জি হ্যা, হে আমার রব’। তিনি বললেন, ‘এটা শুধু তোমার জন্য’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা চাইলে এ আয়াত পড়ে দেখ :

﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾

‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে?’[{আয়াত সূরা মুহাম্মদ : ২২} বুখারী : ৫৯৮৭]
আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

. إنَّ الرَّحِمَ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ تُنَادِي بِلِسَانٍ لَهَا ذُلَقٍ : اللَّهُمَّ صِلْ مَنْ وَصَلَنِي ، وَاقْطَعْ مَنْ قَطَعَنِي.

‘নিশ্চয় আত্মীয়তা-সম্পর্ক আরশকে আকঁড়ে ধরা একটি কাণ্ড, যা জিহ্বার ডগা দিয়ে বলে, ‘হে আল্লাহ, তুমি তার সাথে জুড়ো যে আমার সাথে জুড়ে আর তুমি তাকে ছিন্ন করো যে আমাকে ছিন্ন করে।’ তখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতা‘আলা বলেন, ‘রহীম রহমান (আমি দয়ালু, পরম করুণাময়) আর ‘রাহীম’ (الرحم)  তথা আত্মীয়তা-সম্পর্ক শব্দটিকে আমার নাম থেকে বের করেছি। সুতরাং যে এর সাথে সুসম্পর্ক রাখবে আমি তার সাথে সুম্পর্ক রাখবো আর যে এ সম্পর্ক ভঙ্গ করবে আমি তার সাথে সম্পর্ক ভঙ্গ করবো।’[ইবন আব্দির রাজজাক, মুসান্নফ : ২৫৯০১]
আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের আগে বাণিজ্য সফরে শাম দেশে গেলে বাদশা হেরাকল তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবরণ জানতে চান। জবাবে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবরণ তুলে ধরেন এভাবে :

يَأْمُرُنَا بِالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ وَالْعَفَافِ وَالصِّلَةِ.

‘তিনি আমাদের আল্লাহর ইবাদত, সালাত, সত্যবাদিতা, চারিত্রিত শুভ্রতা ও আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখার আদেশ করেন।’[বুখারী : ৫৯৮০]
আমরা এ থেকে জানতে পারি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের সূচনাকালে যেসব বিষয়ের দাওয়াত দিয়েছেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক তার মধ্যে অন্যতম। আমরা আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করতে পারি দু‌ভাবে। এক. কিছু কাজ করার মাধ্যমে। যেমন : আত্মীয়দের সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং তাদের সঙ্গে সদাচার অব্যাহত রাখা। দুই. কিছু কাজ না করার মাধ্যমে। যেমন : আত্মীয়দের কষ্ট না দেয়া এবং তাদের অনিষ্ট না করা। প্রথমটি আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার সর্বোচ্চ স্তর আর দ্বিতীয়টি সর্বনিম্ন স্তর।
উল্লেখ করা দরকার, আত্মীয়তা-সম্পর্ক আবার কয়েক ধরনের। প্রথম. সাধারণ মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক। এটি আসলে দীনদারির ভিত্তিতে সম্পর্ক, যা তাকওয়ার একটি শাখাও বটে। এটি অর্জিত হয় নিম্নোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে :
একে অন্যের শুভ কামনা করা, পরামর্শ নেয়া, পরস্পরকে ভালোবাসা, ন্যায়-ইনসাফ রক্ষা করা, ওয়াজিব বা জরুরী হক এবং যথাসাধ্য নফল বা ঐচ্ছিক হকসমূহ আদায় করা, মানুষকে সুশিক্ষা দেয়া, সুপথ দেখানো, দিক-নির্দেশনা দেয়া, সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ও অন্যের দুখে সমব্যথী হওয়া এবং মানুষের জন্য কষ্ট দূর করা। আর আমরা তো জানিই যে, মুসলিম ভাইয়ের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা।

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার ফযীলত
আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার দ্বারা মানুষের হায়াত লম্বা হয় এবং ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়। এটি কিন্তু যার তার কথা নয়; মহা সত্যবাদী, চরম শত্রু  কাফেরদের পক্ষ থেকে আল-আমীন বা বিশ্বস্ত উপাধী লাভকারী আল্লাহর নবীর ওয়াদা, যার সম্পর্কে কুরআনে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে এভাবে,

﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى (3) إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى (4) ﴾

‘তিনি আর মনগড়া কথা বলেন না। তাতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরণ করা হয়।’[সূরা আন-নাজম : ৩-৪]
তিনি ইরশাদ করেন,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ

‘যে ব্যক্তি কামনা করে তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘ হোক সে যেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখে।’[বুখারী : ৫৯৮৫; মুসলিম : ৪৬৩৯]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাও বলে গেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার কৃতিত্ব তারই প্রাপ্য যে অন্য পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও নিজের পক্ষ থেকে তা জোড়া লাগায়। পক্ষান্তরে যার সাথে সম্পর্ক বহাল রয়েছে, তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করলে ব্যাস তা হবে সর্বোচ্চ ভালো সম্পর্কের প্রতিদানে ভালো সম্পর্ক। এটি যদিও আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মধ্যেই পড়ে কিন্তু যে ব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে এমন আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক জুড়বে তার সওয়াব অনেক বেশি এবং তার প্রতিদান অনেক বড়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَيْسَ الْوَاصِلُ بِالْمُكَافِئِ وَلَكِنْ الْوَاصِلُ الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا

‘সে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষাকারী নয় যে সম্পর্ক রক্ষার বিনিময়ে সম্পর্ক রক্ষা করে। বরং প্রকৃত আত্মীয়তা-সম্পর্ক রাকারী সেই, যার সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরলে সে তা জোড়া দেয়।’[বুখারী : ৫৯৯১]
মহান এই দীনে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, কাফেরদের সাথেও সম্পর্ক রাখতে আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার সাথে সম্পর্ক অমলিন রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قَدِمَتْ عَلَيَّ أُمِّي وَهِيَ مُشْرِكَةٌ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاسْتَفْتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُلْتُ وَهِيَ رَاغِبَةٌ أَفَأَصِلُ أُمِّي قَالَ نَعَمْ صِلِي أُمَّكِ

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় আমার আম্মা মুশরিক থাকতে একবার আমার কাছে আগমন করলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী, আমি কি আমার আম্মার সাথে সম্পর্ক রাখবো? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যা, তুমি স্বীয় মাতার সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখো।’[বুখারী : ২৬২০; মুসলিম : ২৩৭২]
প্রিয় পাঠক, আমাদের প্রিয় ধর্মে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মর্যাদা এমনই। আমরা কি আল্লাহর নির্দেশ সম্পর্কে অবগত? আমরা পালন করি তাঁর নির্দেশ? বর্জন করি তার নিষেধকৃত বিষয়গুলো? ভেবে দেখুন, আমরা কি আত্মীয়তা-সম্পর্কই ঠিক রাখি? তাদের সাথে সাক্ষাৎ করি? তাদের খোঁজ-খবর নেই? আমরা তাদের সাথে যোগাযোগহীনতা, তাদের ব্যাপারে অন্তরের অনুদারতাকে ক্ষমার যোগ্য ভাবছি?
হে দুনিয়া-আখিরাতের সাফল্য প্রত্যাশী ভাই, আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখুন। আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করবেন না কখনো। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখলে, তাদের সাথে যোগাযোগ ঠিক রাখলে কত বেশি সওয়াব আর কত লাভ তা সবসময় মনে রাখবেন।
জানেন কি আত্মীয়তা-সম্পর্ক ঠিক রাখলে কত লাভ?এর লাভ দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতে। সংক্ষেপে সেদিকে ইশারা করছি :
ক.  আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের পূর্ণতা ও ইসলামের সৌন্দর্যের প্রকাশ।
খ.  আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা রিজিক ও হায়াত বৃদ্ধির কারণ।
গ.  আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়।

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্বসূরী বুযুর্গদের উক্তি  
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তোমরা তোমাদের বংশগতি বিদ্যা শিক্ষা করো অতপর আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করো। আল্লাহর কসম! নিশ্চয় তোমাদের একজনের সাথে তার ভাইয়ের বিবাদ হবে, যদি সে জানতো তার ও এর মাঝে আত্মীয়তা-সম্পর্কের কী গুরুত্ব রয়েছে তাহলে তা তাদের এই সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত রাখতো।’ (তাফসিরে তাবারী : ১/১৪৪)
আতা বিন আবি রাবাহ রহ. বলেন, ‘আমি আমার আত্মীয়র জন্য এক টাকা খরচ করাকে দরিদ্র ব্যক্তির জন্য এক হাজার টাকা খরচ করার চেয়ে উত্তম মনে করি। একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, হে আবু মুহাম্মদ, যদি আত্মীয়টি ধনাঢ্যতায় আমার মতো হয় তবুও? তিনি বললেন, যদি সে তোমার চেয়েও বড় বিত্তশালী হয় তবুও।’ (ইবনে আবিদ্দুনিয়া, মাকারিমুল আখলাক : ৬২ পৃ.)
সাঈদ বিন মুসায়্যাব রহ. কিছু অর্থ রেখে গিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি জানেন আমি টাকা কেবল নিজের দীন ও বংশকে নিরাপদ রাখার জন্য সঞ্চয় করেছি। যে ব্যক্তি অর্থ সঞ্চয় করল না আর তা দিয়ে অন্যের পাওনা পরিশোধ করল না এবং আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করতে পারল আর নিজেকে বাঁচাতে পারল না, তাতে কোনো কল্যাণ নেই।’ (ইবনে মুফলিহ, আদাবে শরইয়্যা : ৩/২৬২।)
আমর বিন দিনার রহ. বলেন, ‘নিশ্চিত জেনো, ফরজ আদায়ের জন্য কদম ফেলার সর্বোত্তম পদক্ষেপ সেটি, যা আত্মীয়তা-সম্পর্ক রার জন্য ফেলা হয়।’
সুলাইমান বিন মুসা রহ. বলেন, ‘আব্দুল্লাহ বিন মুহাইরিসকে জিজ্ঞেস করা হলো, আত্মীয়তা-সম্পর্কের হক কী? তিনি বললেন, যখন সে এগিয়ে আসে তখন তাকে স্বাগত জানানো আর যখন সে পিছিয়ে যায় তখন তার পেছনে যাওয়া।’ (প্রাগুক্ত)
আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে সতর্কিকরণ
এ আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মধ্যে যেমন অনেক সওয়াব ও বড় নেকি রয়েছে, তেমনি তা নষ্ট করার মধ্যে রয়েছে অনেক গুনাহ ও ক্ষতিকারিতা। যেমন : বলা হয়েছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকারী জান্নাতে যাবে না। জুবাইর বিন মুতয়িম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعُ رَحِمٍ

‘আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’[বুখারী : ৬৬৮৫; মুসলিম : ৪৬৩৭]
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে এ সম্পর্ক ছিন্নকারী যেন উত্তপ্ত বালি ভক্ষণ করে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لِي قَرَابَةً أَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُونِي وَأُحْسِنُ إِلَيْهِمْ وَيُسِيئُونَ إِلَيَّ وَأَحْلُمُ عَنْهُمْ وَيَجْهَلُونَ عَلَيَّ فَقَالَ لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمْ الْمَلَّ وَلَا يَزَالُ مَعَكَ مِنْ اللَّهِ ظَهِيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমার কিছু আত্মীয় রয়েছে- আমি তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করি আর তারা তা নষ্ট করে, আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি আর তারা আমার সাথে মন্দ ব্যবহার করে এবং তারা আমার সাথে মূর্খতাসূলভ আচরণ করে আর আমি তাদের আচরণে ধৈর্য্য ধরি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঘটনা যদি তেমনই হয় যেমন তুমি বলছো, তাহলে তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত বালু খাওয়াচ্ছো আর যতক্ষণ তুমি তোমার এ অবস্থানে থাকবে, তোমার সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্যকারী থাকবে।’[বুখারী : ৬৬৮৯; মুসলিম : ৪৬৪০]
তাছাড়া আগেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকারীর জন্য রয়েছে আল্লাহর লানত ও শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ (22) أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ (23) ﴾

‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই যাদেরকে আল্লাহ লানত করেন, তাদে কে বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন।’[সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ (25) ﴾

‘আর যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই লা‘নত আর তাদের জন্যই রয়েছ আখিরাতের মন্দ আবাস।’[সূরা আর-রা‘দ : ২৫]
আর আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকরার সবচেয়ে বড় নমুনা হলো পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা। তারপর যে সবচেয়ে কাছের তার সাথে, তারপর যে সবচেয়ে নিকটতর তার সাথে। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ ثَلَاثًا قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ

‘আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করবো না? কথাটি তিনি তিনবার বললেন। আমরা বললাম, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং পিতামাতার অবাধ্য হওয়া।’[বুখারী : ২৬৫৪; মুসলিম : ২৭০]
হায় আল্লাহ! পিতামাতার অবাধ্য হওয়া কত বড় অপরাধ যে আল্লাহর সাথে শিরকের সাথে সাথেই এর কথা বলা হয়েছে!
আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করার আরেকটি হলো, আখিরাতের আগেই দুনিয়াতে এর শাস্তি প্রদান করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مَا مِنْ ذَنْبٍ أَحْرَى أَنْ يُعَجِّلَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى الْعُقُوبَةَ لِصَاحِبِهِ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ الْبَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ

‘আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করা ও জুলুমের চেয়ে অধিক উপয্ক্তু কোনো অপরাধ নেই যার শাস্তি সত্বরই দুনিয়াতে দেয়া হয়। অথচ আখিরাতের শাস্তি তার জন্য বরাদ্দই থাকে।’[মুসনাদে আহমদ : ২০৪১৪]
আল্লাহকে ভয় করার আহ্বান  
অতএব হে আল্লাহর বান্দাগণ, আল্লাহকে ভয় করুন এবং আত্মীয়তা-সম্পর্ক ঠিক রাখুন। আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করুন তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, তাদেরকে উপহার দেয়া, তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় করার মাধ্যমে। তাদের সাথে সম্পর্ক রাখুন ভালোবাসা, আন্তরিকতা, নম্র কথা, হাসিমুখ, সম্মান, শ্রদ্ধা এবং সমাজে প্রচলিত সব ধরনের আত্মীয়তা রক্ষার উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে। কামিয়াব হোন এর দ্বারা দুনিয়াতে ও আখিরাতে।  আর অবশ্যই আপনারা এ সম্পর্ক নষ্ট করবেন না। কারণ তা দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতের ক্ষতি ও বিপদ ডেকে আনে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।

হাদিসের গল্প – জাবের (রা:)-এর মেহমানদারী ও রাসূ্ল (সাঃ)-এর মুজিযা

সংকলন ও প্রকাশনায় : কুরআনের আলো টিম
miracle-for-earthজাবের (রা:) বলেন, খন্দকের যুদ্ধের প্রাক্কালে আমরা পরিখা খনন করছিলাম। এমন সময় একটা শক্ত পাথর দেখা দিল। তখন লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এসে বলল, পরিখা খননকালে একটি শক্ত পাথর পাওয়া গেছে। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা আমি নিজেই খন্দকের মধ্যে নামব। অতঃপর তিনি দাঁড়ালেন, সে সময় তাঁর পেটে পাথর বাঁধা ছিল।আর আমরাও তখন তিনদিন পর্যন্ত কিছু খেতে পায়নি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোদাল হাতে নিয়ে পাথরটির উপর আঘাত করলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বালুকণায় পরিণত হয়।
জাবের (রা:) বলেন, আমি আমার স্ত্রীর নিকটে এসে বললাম, ‘তোমার কাছে খাওয়ার কিছু আছে কি? আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে ভীষণ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দেখলাম। তখন সে একটি চামড়ার পাত্র হতে এক ছা‘পরিমাণ যব বের করল। আমাদের একটি মোটাতাজা বকরীর বাচ্চা ছিল। তা আমি যবেহ করলাম আর আমার স্ত্রী যব পিষল। অবশেষে আমরা হাঁড়িতে গোস্ত চড়ালাম।
অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এসে চুপে চুপে বললাম, ‘আল্লাহ্‌র  রাসূলুল্লাহ(সাঃ)!  আমরা একটি বকরীর বাচ্চা যবেহ করেছি। আর এক ছা’যব ছিল, আমার স্ত্রী তা পিষেছে। সুতরাং আপন আরো কয়েকজন সঙ্গে নিয়ে চলুন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উচৈচঃস্বরে সবাইকে বললেন, ‘হে পরিখা খননকারীগণ! এস তোমরা তাড়াতাড়ি চল, জাবের তোমাদের জন্য খাবার তৈরী করেছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে বললেন, ‘তুমি বাড়ী ফিরে যাও। আমি না আসা পর্যন্ত গোস্তের ডেকচি নামাবে না এবং খামির থেকে রুটিও বানাবে না। এরপর তিনি লোকজনসহ উপস্থিত হলেন। তখন আমার স্ত্রী খামিরগুলি রাসূলের সম্মুখে দিলে তিনি তাতে লালা মিশিয়ে দিয়ে বরকতের জন্য দোআ করলেন।
অতঃপর ডেকচির নিকট অগ্রসর হয়ে তাতেও লালা মিশিয়ে বরকতের জন্য দোআ করলেন। এরপর বললেন, ‘তুমি আরো রুটি প্রস্ত্ততকারিণীদের ডাক, যারা তোমার সাথে রুটি বানাবে। আর চুলার উপর থেকে ডেকচি না নামিয়ে তুমি তা থেকে তরকারী নিয়ে পরিবেশন কর’।
জাবের (রা:) বলেন, ‘ছাহাবীদের সংখ্যা ছিল এক হাযার। আমি আল্লাহ্‌র কসম করে বলছি, সকলে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে চলে যাওয়ার পরও ডেকচি ভর্তি তরকারী ফুটতেছিল এবং প্রথম অবস্থার ন্যায় আটার খামির হতে রুটি প্রস্তুত হচ্ছিল’ (মুত্তাফাকুন আলাই, মিশকাত হা/৫৮৭৭ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’অধ্যায়, ‘মু‘জিযা’অনুচেছদ) ।

শিক্ষা:

১. কর্মীদের উৎসাহ ও প্রেরণা দানের জন্য নেতাকে তাদের সাথে যে কোন কাজে নিজ হাতে সহযোগিতা করা।
২. কর্মীদের অন্যতম কর্তব্য হল নেতার সার্বিক বিষয়ের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা।
৩. রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পক্ষ হতে প্রকাশিত প্রত্যেক মুজিযার প্রতি সুনিশ্চিত বিশ্বাস রাখা।
৪. দ্বীনের পথে যত কষ্টই আসুক না কেন হাসিমুখে তা বরণ করে নেওয়া।

শায়খ আলবানী (রহ:)-এর বৈচিত্র্যময় জীবনের কিছু স্মৃতি

সংকলনে : আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব

পিতার সাথে বিরোধ 

শায়খ আলবানী কট্টর হানাফী পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আলবেনীয় ও সার্বীয় আলেমদের মধ্যে হানাফী ফিকহ সম্পর্কে সবচেয়ে বিজ্ঞ এবং নির্ভরযোগ্য আলেম। তাঁর নিকটে সবাই ফৎওয়া নিতে আসত। কিন্তু শায়খ আলবানী শুরু থেকেই ছিলেন ভিন্ন মানসিকতার। বিশেষতঃ কুরআন-হাদীছের গভীরভাবে অধ্যয়ন করার পর তাঁর নিকটে সমকালীন বিভ্রান্তি ও ভুল-ত্রুটিসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুঁজে পান কুরআন-হাদীছের সাথে বহু মাসআলা-মাসায়েলের যোজন যোজন দূরের ব্যবধান। বিভিন্ন মসজিদে তখন হানাফী এবং শাফেঈদের দু’টি করে জামা‘আত হ’ত। হানাফী জামা‘আতের পর শাফেঈদের জামা‘আত হ’ত। কিন্তু সময়ের আবর্তনে সিরিয়ায় একজন শাফেঈ শাসক ক্ষমতাসীন হন এবং তিনি হানাফীদের পূর্বে শাফেঈদের ছালাত আদায় করার নির্দেশ জারী করেন। এমতাবস্থায় শায়খ আলবানী দ্বিতীয় জামা‘আতে ছালাত আদায়ের কোন দলীল না পেয়ে শাফেঈদের সাথে আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা শুরু করলেন। একদিন হানাফীদের ইমাম শায়খ বুরহানী হজ্জের সফরে গমনের কারণে শায়খ আলবানীর পিতাকে ইমামতির দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। পরিস্থিতি এমন হ’ল যে, শায়খ আলবানী প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করছেন, আর তাঁর পিতা দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করছেন। পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ল, যেদিন তাঁর পিতা তার ব্যক্তিগত সফরে যাওয়ার কারণে উপলক্ষে আলবানীকে দ্বিতীয় জামা‘আতে ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন। স্পষ্টভাষী আলবানী স্বীয় পিতাকে বললেন, এ বিষয়ে আপনি আমার মতামত জানেন যে, আমি প্রথম জামা‘আতে ছালাত আদায় করি। এমতাবস্থায় স্বীয় মত বিরোধী কাজ করা আমার জন্য খুবই কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধ তীব্রতর হ’ল। অতঃপর একদিন পিতা তাকে গৃহকোণে ডেকে বললেন, তাহ’লে এটাই কি সত্য যে, তুমি তোমার মাযহাব পরিত্যাগ করেছ? ক্রোধান্বিত পিতার কণ্ঠ ঊঁচু হ’তে লাগল। একপর্যায়ে বললেন, হয় তোমাকে একমত হ’তে হবে, অন্যথায় পৃথক হ’তে হবে। শায়খ আলবানী পিতার নিকট থেকে তিনদিন সময় চেয়ে নিলেন। অবশেষে মাত্র ২৫ সিরীয় লিরা হাতে নিয়ে পিতৃগৃহ থেকে বিদায় নিলেন পরবর্তীকালের বিশ্ববিশ্রুত এই মুহাদ্দিছ। তখন তাঁর বয়স সবেমাত্র কুড়ি অতিক্রম করেছিল। সেই বয়সেই তিনি الروض النضير في ترتيب وتخريج معجم الطبراني الصغير নামক একটি তাখরীজ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যদিও তা অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।

পেশাজীবী আলবানী 

শায়খ আলবানীর পিতা জীবিকা নির্বাহের জন্য ঘড়ি মেরামত করতেন। আলবানী পিতার দোকানে কাজ করেই একাজে দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি বলতেন, ঘড়ি মেরামতের কাজই আমাকে সূক্ষ্মতা শিখিয়েছে। পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর পড়াশুনার পাশাপাশি কর্মজীবনের শুরুতে দু’বছর কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। অতঃপর কাজটি কষ্টসাধ্য হওয়ায় তিনি পুরাতন গৃহ সংস্কারের পেশা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি আবার ঘড়ি মেরামতের পেশায় ফিরে গেলেন। তাঁর নিজস্ব ঘড়ির দোকান ছিল। তিনি বলতেন, আল্লাহ্র অশেষ রহমত যে, তিনি আমাকে প্রথম যৌবনেই ঘড়ি মেরামতের কাজ শেখার তাওফীক্ব দান করেছিলেন। এটা এমন একটি স্বাধীন পেশা, যা ইলমে হাদীছে বুৎপত্তি অর্জনে আমার জন্য বাধা হ’ত না। আমি মঙ্গলবার ও শুক্রবার ব্যতীত প্রতিদিন মাত্র তিন ঘণ্টা এর পিছনে ব্যয় করি। এই পরিমাণ কাজ করাই আমার ও আমার পরিবারের প্রয়োজনীয় জীবিকা অর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল। অর্থাৎ এর বেশী আর প্রয়োজন নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ) এ দো‘আই করতেন যে, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারের জন্য এমন রিযিক দান কর যা পরিমিত। অর্থাৎ প্রয়োজনের কম নয় বা বেশীও নয় (ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আহদাছুন মুছীরাহ মিন হায়াতিল ইমাম আলবানী)।

দারিদ্রক্লিষ্ট আলবানী 

প্রথম জীবনে শায়খ আলবানীকে চরম দারিদ্রের মুকাবিলা করতে হয়েছিল। শায়খ মাশহূর হাসান বলেন, শায়খ আলবানী আমাকে সিলসিলা যঈফাহ ছাপাখানায় যাওয়ার পূর্বে এর সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি তাঁর নিকট থেকে পঞ্চম খন্ডের পান্ডুলিপি গ্রহণ করে যখন ব্যাগ থেকে বের করলাম, দেখলাম তিনি পঞ্চম খন্ডটি চিনি, চাল প্রভৃতির প্যাকেটসহ মানুষের ফেলে দেয়া লাল রঙের পরিত্যক্ত কাগজে লিখেছেন! অবস্থা দেখে আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললাম। শায়খ আমার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু আমি কথা বলতে পারছিলাম না। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, দেখ আমার কাছে তখন ভাল কাগজ ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না (ইসতামে‘ ইলাইহে মিন কালামিশ শায়খ আবী ওবায়দা, অডিও রেকর্ড থেকে সংগৃহীত)।
তার আরেক ছাত্র আবু মু‘আবিয়া বৈরূতীর ভাষায় তিনি দারিদ্রের কারণে কাগজ ক্রয় করতে না পেরে রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ কুড়িয়ে নিতেন এবং তাতেই তাঁর অমূল্য লেখনীর প্রকাশ ঘটাতেন। একদিন তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘সস্তা হওয়ার কারণে আমি পরিত্যক্ত কাগজ কেজি দরে ক্রয় করতাম’ (শায়বানী, হায়াতুল আলবানী ১/৪৩)।

বইয়ের পোকা আলবানী 

তিনি হাদীছের মুদ্রিত গ্রন্থাবলী ও দুর্লভ পান্ডুলিপি অধ্যয়নের জন্য দামেশকের সুপ্রাচীন যাহেরিয়া লাইব্রেরীতে প্রত্যেক দিন ৬/৮ ঘণ্টা নিয়মিত পড়াশুনা করতেন। কখনো কখনো ১২ ঘণ্টা অবধি চলত নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা। অনেক সময় লাইব্রেরীর সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধ্যয়নে কেটে যেত। কর্তৃপক্ষ তাঁর পড়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি কক্ষ বরাদ্দ করেন এবং সার্বক্ষণিক উপকৃত হওয়ার জন্য লাইব্রেরীর একটি চাবি তাঁকে প্রদান করেন। তিনি ইবনু আবিদ দুনয়ার ‘যাম্মুল মালাহী’ গ্রন্থের পান্ডুলিপির বিনষ্ট হয়ে যাওয়া একটি পৃষ্ঠা উদ্ধারের জন্য উক্ত লাইব্রেরীর প্রায় ১০ হাযার পান্ডুলিপি অধ্যয়ন করেন (মুহাম্মাদ বাইয়ূমী, ইমাম আলবানী হায়াতুহু দাওয়াতুহু ওয়া জুহূদুহু ফী খিদমাতিস সুন্নাহ ২৩-২৫ পৃঃ)।

জহূরী জহর চেনে 

হজ্জের মওসুম। শায়খ আলবানী হজ্জে গিয়েছেন। এদিকে মিশকাতের প্রসিদ্ধ আরবী ভাষ্য ‘মির‘আতুল মাফাতীহ’-এর লেখক স্বনামধন্য সালাফী বিদ্বান ভারতগুরু শায়খ ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরীও হজ্জে গিয়েছেন। ইন্ডিয়ার আহলেহাদীছ নেতা শায়খ মুখতার আহমাদ নাদভী মিনাতে শায়খ আলবানীর তাঁবুতে আল্লামা মুবারকপুরীকে নিয়ে গেলেন। কেবল নামটি বলার অপেক্ষা। আর যাবেন কোথায়! শায়খ আলবানী বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। যেন কতদিনের স্বপ্ন আজ স্বার্থক হ’ল। শায়খ মুখতার বলেন, ইসলামী দুনিয়ার দুই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছের সেই মহামিলন দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলের সেদিন আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিল।

বিনয়-নম্রতার মূর্ত প্রতীক 

(১) শায়খ আলবানীর প্রিয় ছাত্র শায়খ আলী হালাবী বলেন, একদিন আমি শায়খকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনার মৃত্যুর পর আমরা ইলমে হাদীছে কার উপর নির্ভর করব? তিনি বললেন, তোমরা নিজেদের উপরেই নির্ভরশীল হও। আমি কামনা করি তোমরা আলবানীর চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে।
(২) মিসরীয় আলেম শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী তাঁর উস্তাদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি ভুলতে পারি না সেদিনের কথা যেদিন আমি উস্তাদ আলবানীকে আমার তাখরীজকৃত ইমাম আবুদাঊদ রচিত البعث নামক বইটি উপহার দিলাম। তিনি যখন বইয়ের কভারে خرج أحاديثه الشيخ الحويني السلفي লেখা দেখলেন, তখন বিস্মিত হয়ে الشيخ শব্দের দিকে ইশারা করে বললেন, এটা কেন? আমি ওযর পেশ করে বললাম, শায়খ! এটা আমার কাজ নয় বরং প্রকাশকের ভুল। কিন্তু তিনি আমার ওযর গ্রহণ করলেন না। আললাহর কসম! আমি মোটেও কষ্ট পাইনি। বরং এরপর থেকে আমি তাঁকে ভিন্ন মাত্রায় শ্রদ্ধা করতে লাগলাম এবং আমার হৃদয়ে তিনি যেন একটি বিশেষ স্থানে আসীন হ’লেন। কারণ হাদীছ শাস্ত্রের অবিসংবাদিত ইমাম হিসাবে যাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া, তিনি যে নিজেই স্বীয় গ্রন্থে কেবল নাম ব্যতীত কিছুই লিখতেন না! (আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী, বাযালুল ইহসান বিতাকরীবি সুনান নাসাঈ)।
(৩) শায়খ আবু ইসহাক আল-হুওয়াইনী বলেন, একদিন আমরা কয়েকজন তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি নিজেই দরজা খুললেন এবং সহাস্যবদনে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা সবাই তাঁর বাড়ীর বাগানে গিয়ে বসলাম। অতঃপর তিনি আমাদেরকে তাঁর সাথে নাশতা করতে বাধ্য করলেন। তিনি নিজে হাতে খাবার এনে আমাদের খাওয়াচ্ছিলেন। আমি উঠে তাঁকে সাহায্য করতে চাইলাম। কিন্তু তিনি ধমক দিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলেন। আমি বিব্রতভাবে বললাম, শায়খ! আমি বসে থাকব আর আপনি আমার খেদমত করবেন, এটা তো আমার জন্য খুবই অভদ্রতার পরিচয়। উত্তরে শায়খ আলবানী মনের রাখার মত যে কথাটি বললেন, ‘দেখ, الامتثال هو الأدب، بل هو خير من الأدب ‘রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করাই হ’ল ভদ্রতা। বরং ভদ্রতার চাইতেও উত্তম’ (বাদরুত তামাম ফী তারজামাতিশ শায়খ আল-ইমাম)।

নিজের দোষ-ত্রুটি শিকারে দ্ব্যর্থহীন 

একদিন জনৈক ছাত্র শায়খ আলবানীর একটি ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তার জন্য দো‘আ করে বললেন, এর জন্য আল্লাহ তোমাকে উত্তম জাযা দান করুন এবং আমাদের পারস্পরিক মহববতকে এমন মহববতে পরিণত করুন, যা পরস্পরকে উপদেশ প্রদান এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হয়। কেননা অনেক মানুষ অপরকে বলে থাকে যে, আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। কিন্তু যখনই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে কোন দোষ-ক্রটি করে ফেলে, তখন তাকে দূরে ঠেলে দেয় ও তার মর্যাদাহানি করে। এটা কখনোই ‘আল্লাহ্র জন্য ভালোবাসা’র নিদর্শন নয়। বরং যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়া হবে তখনই তা প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব বলে গণ্য হবে। সুতরাং যখন তুমি আমার কোন ভুল-ক্রটি দেখবে, তখন অবশ্যই আমাকে সংশোধন করে দিবে (সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, আলবানীর বক্তব্যের অডিও রেকর্ড ৮২/৩:৭)। তিনি বলতেন, السَّعيد من وُعظ بغيره সৌভাগ্যবান সেই যে অন্যের দ্বারা উপদেশ/পরামর্শ প্রাপ্ত হয়।

তিন মনীষীর মহামিলন 

শায়খ আলবানী জীবনের শেষ হজব্রত পালনকালে মিনায় অবস্থান করছেন। সেখানে তিনিসহ আরো রয়েছেন শায়খ বিন বায এবং শায়খ উছায়মীন। তাদের উপস্থিতিতে বিরাট মজলিসে প্রশ্নোত্তর বৈঠক শুরু হ’ল। সভাপতি হিসাবে শায়খ বিন বায প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য হাদীছ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর শায়খ আলবানীকে, ফিক্বহী প্রশ্নের উত্তর শায়খ উছায়মীনকে এবং আক্বীদাগত প্রশ্নের উত্তর প্রদানের দায়িত্ব নিজেই নিলেন। অতঃপর যোহরের সময় হ’ল। শায়খ বিন বায শায়খ আলবানীকে বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান! আজ আপনি ছালাতে আমাদের ইমামতি করবেন, আপনি আমাদের ইমাম। শায়খ আলবানী অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, না না শায়খ, বরং আপনাকেই ইমামতি করতে হবে, আপনি আমাদের শায়খ। শায়খ বিন বায বললেন, আমরা কুরআনের ক্ষেত্রে সকলেই সমান হ’তে পারি। কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের মাঝে সর্বাধিক অবগত। সুতরাং আপনিই ইমামতি করুন। অবশেষে শায়খ আলবানী ইমামতির জন্য এগিয়ে গেলেন এবং বললেন, হে শায়খ! আমি কি রাসূল (ছাঃ)-এর ন্যায় ছালাত আদায় করব, না সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করব? শায়খ বিন বায বললেন, রাসূল (ছাঃ)-এর অনুরূপ ছালাত আদায় করুন এবং আমাদেরকে শিখিয়ে দিন কিভাবে রাসূল (ছাঃ) ছালাত আদায় করতেন।

গাড়িচালক আলবানী 

শায়খ আলবানী একদিন নিজের গাড়ি চালাচ্ছিলেন। জনৈক ছাত্র তাঁর গাড়িতে উঠলো। শায়খ আলবানী তখন দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ছাত্রটি ভয় পেয়ে তাঁকে বলল, শায়খ! গাড়ির গতি ধীর করুন। শায়খ বিন বায বলেছেন, জোরে গাড়ি চালানো নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করার শামিল। উত্তরে শায়খ আলবানী বললেন, এই ফৎওয়া গাড়ি চালনায় অদক্ষদের জন্য, আমার জন্য নয়। ছাত্রটি বলল, আমি কি আপনার এই কথাটি শায়খ বিন বাযকে শোনাবো? তিনি বললেন, হ্যা, তাঁকে বল। পরে ছাত্রটি একথা শায়খ বিন বাযকে জানালে তিনি হাসতে লাগলেন এবং বললেন, তাঁকে বল এই ফৎওয়া তাদের জন্য যাদের এ্যাকসিডেন্ট করে রক্তপণ দেয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি (সঊদী আরবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তাই যাদের একবার এরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারা এমনিতেই সাবধানে গাড়ি চালায়) (তরজমাতুস সাদহান লিশ শায়খ বিন বায)।

খেলাধুলায় আলবানী 

শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ (মৃত্যু ১৪৩২হিঃ) বলেন, মদীনায় অনেক বিখ্যাত আলেম-ওলামার সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। তাঁদের মধ্যে শায়খ আলবানী ছিলেন আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমরা একত্রে বহুবার সফর করেছি। তিনি একাধারে আমার উস্তাদ এবং বন্ধু ছিলেন। যে বিষয়েই তাঁর সাথে কথা বলা হোক না কেন, তিনি হাদীছ দিয়ে কথা বলতেন এবং সনদের শুদ্ধাশুদ্ধি উল্লেখ করতেন। কুরআন থেকে তিনি এমনভাবে দলীল দিতেন যেন কুরআন তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। একবার মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে আমরা মাঠে নামলাম। ছাত্ররা ফুটবল খেলছিল। শায়খ আলবানীও নিজের পোষাক পরিহিত অবস্থাতেই মাঝে মাঝে তাদের সাথে খেলছিলেন। আমি বললাম, আপনি করছেন কি? আপনি ফুটবল খেলছেন, অথচ আপনি আলবানী! উত্তরে তিনি বললেন, أتقوى بها على الطاعة وهي لا تلهيني عن ذكر ربي ‘এর দ্বারা আমি আল্লাহ্র আনুগত্যে শক্তি অর্জন করছি। আর এটি আমাকে আমার প্রভুর স্মরণ থেকে উদাসীন করছে না।’

সৃজনশীল কারিগর 

শায়খ আলবানী ইলমে হাদীছে অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নির্মাণেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন-
(১) অধ্যাপক মাহমূদ রেযা বলেন, একবার শায়খ আলবানী আমাকে তাঁর গৃহের ছাদে নিয়ে গিয়ে স্বীয় উদ্ভাবিত একটি যন্ত্র দেখালেন, যা সূর্যের কিরণে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গরম হ’ত। সালফার, আলকাতরা ইত্যাদি পদার্থের মিশ্রণে নির্মিত এই জটিল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রটি শীতকালে তাঁর ঘরের উষ্ণতা ধরে রাখত (মুহাম্মাদ রেযা মুরাদ, মাসিক আদ-দাওয়াহ, ১৮১৮ সংখ্যা, শা‘বান ১৪২০ হিঃ)।
(২) তিনি সূর্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছালাতের সঠিক সময় নির্ণয়কারী একটি ঘড়ি নির্মাণ করেন। তবে তাঁর বাড়িতে ভ্রমণকারীরা সবচেয়ে বিস্মিত হ’ত তাঁর স্বনির্মিত লিফটটি দেখে, যার মাধ্যমে তিনি উপর তলায় উঠতেন। স্থুল স্বাস্থ্যের কারণে উপরে পায়ে হেঁটে উঠতে তাঁর কষ্ট হ’ত। তাঁর এই লিফটটির সাথে একটি ডায়নামা সদৃশ যন্ত্র যুক্ত করা ছিল। সুইচ টিপ দিলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠা-নামা করত। এছাড়া তিনি বই-পত্র রাখার জন্য একটি ঘূর্ণায়মান র‌্যাক তৈরী করেছিলেন, যেখানে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় বইসমূহ রাখতেন। বিশেষতঃ জারাহ-তা‘দীল এবং রিজাল শাস্ত্রের বইগুলো তিনি এই র‌্যাকে রাখতেন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। এমনকি স্বীয় সন্তান মুহাম্মাদের প্রসবকার্যে তিনি একাই স্ত্রীকে সাহায্য করেছিলেন (ইছাম হাদী, আলবানী কামা ‘আরাফতুহু ১০৪ পৃঃ)।
(৩) বৈদ্যুতিক কাজসহ গাড়ি মেরামতেও তাঁর দক্ষতা ছিল আশ্চর্য ধরনের। একাধিক দাওয়াতী সফরে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তাঁকে নিজেই তা মেরামত করতে দেখা গেছে। তাঁর ছাত্র শায়খ আদনান স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, একবার তিনি শায়খ আলবানীর সাথে রেডিও কিনতে গিয়েছিলেন। আলবানী দোকানীকে রেডিও সম্পর্কে দক্ষ বিশেষজ্ঞের মত প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন। যেমন, রেডিও তরঙ্গ কয়টি? কয়টি ব্যাটারী প্রয়োজন হয়? পাওয়ার কত? কোন দেশে তৈরী ইত্যাদি। তিনি শায়খকে বললেন, এগুলিতো রেডিওর খুব সূক্ষ্ম বিষয়, আপনি বোঝেন কিভাবে? আলবানী বললেন, তুমি কি মনে করেছ, আমাদেরকে কেবল ইলমে হাদীছের ক্ষেত্রেই সূক্ষ্মতা অবলম্বন করতে হবে? না, বরং সর্বক্ষেত্রেই এ নীতি প্রযোজ্য। আমরা কেবল দ্বীনের ক্ষেত্রেই তাক্বলীদকে অস্বীকার করি না। বরং যে কোন বিষয়েই অন্যের তাক্বলীদকে অস্বীকার করি।
(৪) অনুরূপভাবে ইয়ারমূক বিশ্ববিদ্যালয়ের উছূলে ফিক্বহ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফারূক সামেরাঈ স্মৃতিচারণ করে বলেন, শায়খ আলবানীর সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি বাড়িতে হাঁস-মুরগী, কবুতর ইত্যাদি পালন করতেন। একবার তিনি সপরিবারে ওমরা করতে যাবেন। দুই সপ্তাহ বাড়ি খালি থাকবে। কিন্তু এসব প্রাণীর খাদ্য-পানীয়ের সংস্থান কিভাবে হবে? তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর যথারীতি নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি একটি চমৎকার যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন, যা প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য এবং পানীয় প্রত্যেক খাঁচায় ঢেলে দেবে। এভাবে পরিকল্পিত উপায়ে সবকিছু ঠিকঠাক চলতে লাগল। সফর থেকে ফিরে এসে দেখলেন সব পশু-পাখি সুন্দরভাবে খেয়ে-দেয়ে বেঁচে আছে। কোন সমস্যা হয়নি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটিই হয়েছে।
(৫) ড. আব্দুল আযীয সাদহান লিখেছেন, শায়খ আলবানীর বাসায় অনেক পাখি ছিল। পাখিদের বাসা ছিল তাঁর বারান্দা থেকে প্রায় ২০ মিটার দূরে। তাই প্রতিদিন পাখির খাবার ব্যবস্থা করতে তিনি বারান্দা থেকে একটি পাইপ লাগিয়ে দেন। যার অপর মুখটি ছিল পাখির বাসা পর্যন্ত দীর্ঘ। তিনি প্রতিদিন ঐ পাইপটি পাখিদের খাবার দিয়ে ভরে রাখতেন। ফলে অপর মুখ থেকে পাখিরা যখনই কিছু খাবার খেত, তখনই পাইপের মুখে বাকি খাবার অল্প অল্প করে নেমে আসত। ফলে বার বার খাবার দেয়ার পরিশ্রম করতে হত না। এভাবে তাঁর সবকিছুতেই ছিল সৃষ্টিশীলতার ছাপ (ইমাম আলবানী দুরূস ওয়া মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১১১ পৃঃ)।

প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব 

একদিন শায়খ সাম‘আনী শায়খ আলবানীকে তাবলীগ জামা‘আত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি চমৎকার এক উদাহরণ পেশ করে বললেন, এই জামা‘আতের মত ইখলাছপূর্ণ এবং আমলসমৃদ্ধ কোন জামা‘আত আজ পর্যন্ত আমার নযরে পড়েনি। কিন্তু তাদের অবস্থা হ’ল ঐ অতি উৎসাহী কুর্দী ব্যক্তির মত, যে ইসলাম প্রচারের জন্য বের হয়েছে। অতঃপর সামনে একজন ইহুদীকে পেয়ে খঞ্জর উঁচিয়ে বলল, তোমার জন্য ধ্বংস, তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে আত্মসমর্পণ করে বলল, ঠিক আছে ইসলাম গ্রহণ করব। এখন বল, কি বলে আমি ইসলাম গ্রহণ করব? কিংকর্তব্যবিমূঢ় কুর্দী তখন বলল, হায় হায় এটা তো আমার জানা নেই! (অর্থাৎ তারা দ্বীনের তাবলীগ করে বটে; কিন্তু দ্বীন সম্পর্কে তাদের সঠিক জ্ঞান নেই)।

প্রচারবিমুখতা 

১৯৮৪ সালে সঊদী আরব সফরকালে তাঁর এক সঊদী সাথী তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেন এবং এটাও বললেন, আপনার আগমনে সেখানে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি হবে ইনশাআল্লাহ। একথা শুনে আলবানী বেঁকে বসলেন এবং বারংবার নিবেদন সত্ত্বেও কোনক্রমে রাযী হলেন না। বাসায় ফিরে আসলে তার এক সাথী দাওয়াত কবুল না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বললেন, إني أخشي علي نفسي الفةنة আমি আমার উপর ফিতনার আশংকা করছি (অর্থাৎ এতে আমার মধ্যে আত্মগর্বের সৃষ্টি হতে পারে)।
একবার তিনি গাড়িতে বসেছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি তাকে চিনতে পেরে ছুটে এসে বলল, আপনিই কি শায়খ আলবানী? একথা শুনে আলবানী কেঁদে ফেললেন। পরে তাঁকে কাঁদার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ينبغي للمرء أن يجاهد نفسه وأن لا يغتربإشارة الناس إليه ‘প্রত্যেক মানুষেরই উচিৎ আত্মপরিশুদ্ধির জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করা এবং তার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও কৌতুহলের কারণে আত্মপ্রবঞ্চিত না হওয়া (ড. আব্দুল আযীয সাদহান, ইমাম আলবানী দুরূস মাওয়াকেফ ওয়া ইবার ১২৬ পৃঃ)।
আধুনিক যুগের ইলমে হাদীছের এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যময় কর্মকান্ড সত্যিই বিস্ময়কর বৈকি!

কারাজীবনে আলবানী 

শায়খ আলবানীকে বিনা অপরাধে সন্দেহের বশে কয়েকজন আলেমের সাথে কারান্তরীণ হতে হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালে তিনি সিরিয়ার বিখ্যাত কেল‘আ কারাগারে কয়েকমাসের জন্য বন্দী ছিলেন। এই কারাগারেই একসময় বন্দী জীবন কাটিয়েছিলেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (১২৬৩-১৩২৮ইং)।
আলবানী বাইরের ন্যায় কারাভ্যন্তরেও দ্বীনের দাওয়াত দেন এবং তাকলীদ থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ ঈমান ও আমলের প্রতি সকলকে দাওয়াত দেন। তিনি ইবনে তায়মিয়া (রহঃ)-এর পরে সর্বপ্রথম কেল‘আ কারাগারে একত্রে জুম‘আর ছালাত চালু করেন। মুক্তির কিছুদিন পরই তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন এবং প্রায় আট মাস কারাবাস করেন। এসময় তিনি মুনযেরী কর্তৃক সংকলিত মুখতাছার ছহীহ মুসলিমের তাহকীক সম্পন্ন করেন।
Courtesy: মাসিক আত- তাহরীক